শনিবার রাত সাড়ে ৯টা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর একটি কন্টেইনারে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত। পাশের ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে আগুন নিয়ন্ত্রণেও আনে অনেকটা। কিন্তু রাত ১০টা ৪৭ মিনিটে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা। সঙ্গে কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুন, ধোঁয়া। এ যেন কেয়ামতের বিভীষিকা। এরপর একের পর এক বিস্ফোরণ। আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ডিপোতে। কন্টেইনারে থাকা রপ্তানি ও আমদানি পণ্যে ছড়িয়ে পড়া আগুনে পুড়তে থাকে সেখানে থাকা মানুষজনও।
শনিবার রাতে সূত্রপাত হওয়া ৪০ ঘণ্টা পরও পুরো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই সময়ে আগুনে পুড়েছে পুরো ডিপো। ঝরে গেছে অন্তত অর্ধশত প্রাণ। আগুনে দগ্ধ হয়েছেন কয়েক শ’ মানুষ। তাদের অনেকে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। পুড়েছে হাজার কোটি টাকার মালামাল। সেই সঙ্গে পুড়েছে শত শত পরিবারের স্বপ্ন। বিস্ফোরণের পর আহতদের আহাজারি। একের পর এক এম্বুলেন্সের সাইরেন।
আহত ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের বিলাপে ভারী হয়ে উঠে বিএম ডিপোর পাশের পরিবেশ। একই চিত্র দেখা যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায়। দিনভর শোকাতুর এক পরিবেশ পুরো চট্টগ্রামজুড়ে। উদ্বেগ আর আতঙ্ক মানুষের মাঝে। সারাদিন আহতদের নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। এম্বুলেন্সের ছুটাছুটি। নিহতদের লাশ ঘিরে কান্না। নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আসা মানুষের কান্না। অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৫০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় ডিপো এলাকা থেকে। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন অগ্নিযোদ্ধারও মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত তিন শতাধিক। এদের মধ্যে ৪০-৪৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হয়েছেন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।
আহত বেশ কয়েকজনকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে। গুরুতর আহতদের হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গতকাল থেকে ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করেন সেনাসদস্যরা। প্রত্যক্ষদর্শী ও দমকলকর্মীরা জানিয়েছেন, কন্টেইনারে কেমিক্যাল থাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। কেমিক্যালের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেমিক্যালের আগুন পানি ছিটিয়ে নেভাতে দমকলকর্মীদের বেগ পেতে হয়। এই বিস্ফোরণে কম্পনের আওয়াজ এতটাই তীব্র ছিল যে, আশেপাশের এলাকার অধিকাংশ ভবনের কাঁচের গ্লাস ভেঙে যায়। আগুনে ডিপোতে থাকা ৫ হাজার কন্টেইনারের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুড়ে যায়।
উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে প্রায় সবার শরীর আগুনে ঝলসে গেছে। যে কারণে নিহতদের অনেকের পরিচয় তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষা করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নিহত ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের লাশ শনাক্ত করা গেছে। উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের লাশের ৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তাদের মধ্যে ৬ জনের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলায়। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুজিবুর রহমানের বাড়িও এই উপজেলায়। প্রতিষ্ঠানটির তিন শিফটে কাজ চলতো। কর্মরত ৩ শতাধিক শ্রমিকের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেই পরিচালক মুজিবুর রহমানের এলাকার। মুজিবুর রহমান স্মার্ট গ্রুপের পরিচালক ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ।
বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিগডা’র সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান জানিয়েছেন, ওই ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের একটি চালান ছিল। এই রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ মূলত এভিয়েশন শিল্পখাতে ব্যবহৃত হয়। উচ্চ চাপে এই রাসায়নিক বোতলজাত করা হয়ে থাকে। এই হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, কন্টেইনারে কেমিক্যাল ছিল সেটা নিশ্চিত। তবে কি কেমিক্যাল ছিল এবং কি পরিমাণ ছিল সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মালিকপক্ষ আমাদেরকে বিষয়টি খোলাসা করছে না।
বিগডা সূত্রে জানা যায়, ৩০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ডিপোটির কন্টেইনার ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ৫০০ টিইইউ’স। এরমধ্যে শনিবার ডিপোটিতে ঘটনাস্থলে রপ্তানির জন্য ৮০০ টিইইউ’স বোঝাই তৈরি পোশাক এবং হিমায়িত খাদ্যপণ্য ছিল। যেখানে আমদানিকৃত পণ্য বোঝাই কন্টেইনার ছিল ৫০০টি। আর এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ৯ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে, সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে নয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে আগামী তিন কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। একই ঘটনায় কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ হাজার টাকা ও আহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে নিহতদের পরিবারকে ২ লাখ টাকা এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এদিকে ঘটনার বিষয়ে স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, রাসায়নিক পদার্থ ও গার্মেন্টস পণ্য থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই আগুনে হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এরপরও নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা হতাহতদের পাশে থাকবো। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার পর মালিক পক্ষের কেউ ঘটনাস্থল বা হাসপাতালে যায়নি। এমনকি তারা ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকেও সহায়তা করেনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, ডিপোতে কোনো কন্টেইনারে কি পণ্য ছিল তা জানালে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হতো। মালিক পক্ষের কেউ ঘটনাস্থলে আসেননি। তারা এ বিষয়ে কোনো তথ্য না দেয়ায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সমস্যায় পড়তে হয়।
ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী: সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি রাসায়নিক দূষণ ঠেকানোর চেষ্টায় কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর জানিয়েছে, শনিবার রাতে আগুন লাগার পর থেকে সেনাবাহিনীর ২৫০ জন সদস্য সেখানে নিয়োজিত রয়েছেন। উদ্ধার অভিযান ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার এবং নিরাপত্তা দলও নিয়োজিত রয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিস্ফোরণের কারণে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক সামগ্রী সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া রোধে এ দলটি কাজ করছে।
ডিপো এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মিলিটারি পুলিশ সেখানে নিয়োজিত রয়েছে। বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম। ফায়ার সার্ভিসের ১৪ জন সদস্যসহ ১৫ জনকে চট্টগ্রাম সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে।
সকালে ডিপোতে এসে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ডিপোতে ড্রেন আছে, সেই ড্রেন খালে গেছে- সেই খাল আবার সাগরের সঙ্গে সংযোগ আছে। রাসায়নিক যাতে সাগরে না যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সেরও একজন উদ্যোক্তা। তারা মূলত কাঁচামাল আমদানি করে প্রক্রিয়াজাত করার পর জারে ভরে আবার রপ্তানি করেন। আল রাজী রাসায়নিক কমপ্লেক্সের মহাব্যবস্থাপকের (প্রশাসন) দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক ডিআইজি প্রিজন্স মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
সূত্র: মানবজমিন।
Leave a Reply