তীব্র স্নায়ুর পরীক্ষা দিয়ে ফাইনালের মতো এক ফাইনালই দেখেছে গোটা বিশ্ব। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়তর দলের হাতেই উঠেছে বিশ্বকাপের শিরোপা। অভিনন্দন আর্জেন্টিনা। এই শিরোপা তাদের প্রাপ্যই।
৭০ মিনিট পর্যন্ত ফ্রান্সকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি মাঠে। তখনো ২-০ গোলে এগিয়ে থাকা মানে ম্যাচ অনেকটাই হেলে যায় আর্জেন্টিনার দিকে। কিন্তু ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ফ্রান্সের পাওয়া পেনাল্টি।
পরপরই এমবাপ্পে দারুণ এক গোল করে ফাইনালের রং পাল্টে দেয়। ২-২ হওয়ার পর ম্যাচে ভালোভাবে ফিরে আসে ফ্রান্স। অতিরিক্ত সময়ে মহানাটকীয়তার মধ্যে ৩-৩। পুরো কৃতিত্ব কিলিয়ান এমবাপ্পের। হ্যাটট্রিক করে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়েছে সে। ভাবতেই পারিনি এই ম্যাচ এত দূর আসবে।
তারপর তো টাইব্রেকার–নাটক। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা মাথা ঠান্ডা রেখে দারুণভাবে টাইব্রেকারের চাপ সামলাল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মিস হওয়া খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু কাল রাতে আর্জেন্টিনা কোনো ভুল করেনি পেনাল্টি শুটআউটে। অন্যদিকে প্রবল মানসিক দৃঢ়তায় ফ্রান্স যেভাবে ম্যাচে ফিরে এসেছে, তা এককথায় অনন্য। ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত হয়তো ট্রফিটা ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু দিদিয়ের দেশমের দলকেও অভিনন্দন জানাতেই হচ্ছে এমন একটি অবিস্মরণীয় ফাইনাল উপহার দেওয়ার জন্য।
অথচ বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো ম্যাচে প্রথমার্ধটা দেখে অবাক হয়েছিলাম। আর্জেন্টিনার সামনে ফ্রান্স খেলছে তো? নাকি ফ্রান্সের ছায়া দল খেলছে? বিভ্রম হচ্ছিল তখন। ভাবছিলাম, এ কোন আর্জেন্টিনা! এই বিশ্বকাপের সেরা প্রথমার্ধ তো বটেই, গত চার-পাঁচ বছরে এত ভালো খেলতে দেখিনি আর্জেন্টিনাকে। দুর্দান্ত, অসাধারণ শব্দগুলো দিয়েও ঠিক বোঝানো যাবে না এই আর্জেন্টিনাকে।
ফুটবলের পরিভাষায় যদি বলি, প্রথমার্ধে ফ্রান্সকে নিয়ে রীতিমতো খেলল আর্জেন্টিনা। মনে হলো, ডিয়েগো ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা খেলছে সাধারণ মানের কোনো দলের সঙ্গে। প্রথম ১০-১২ মিনিট ফ্রান্সের অর্ধেই খেলা হয়েছে। আসলে গোটা প্রথমার্ধজুড়েই একতরফা খেলে গেছে আর্জেন্টিনা।
বাতাসে সব আক্রমণই তারা জিতেছে। সব চ্যালেঞ্জেও জিতেছে আর্জেন্টিনা। প্রথম পাঁচ-সাতটা আক্রমণের সব ফেলা হয় বাঁ দিকে আনহেল দি মারিয়ার পায়ে। সেখান থেকে কাটিং করে ঢুকেছে সে। দি মারিয়াকে পাস দেওয়া হয়েছে ডান প্রান্ত থেকে। কখনো বাতাসে ভাসানো, কখনো মাটি কামড়ে এবং বেশির ভাগ পাসই দিয়েছে মেসি। যেন একেবারে ছক বাঁধা ফুটবল। একপর্যায়ে মিলেছে পেনাল্টিও।
আর্জেন্টিনার এই দুরন্ত ফুটবলের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ফ্রান্স। দলটির মাঝমাঠের সেরা অস্ত্র আঁতোয়ান গ্রিজমান প্রথম কয়েক মিনিট বলেই পা লাগাতে পারেনি। প্রথমার্ধজুড়ে একটা সঠিক পাসও দেখা যায়নি তার পা থেকে। একটা চ্যালেঞ্জেও জিততে পারেনি গ্রিজমান। কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নিয়ে এত আলোচনা, অথচ প্রথম সাত-আট মিনিটে সে-ও বলে পা লাগাতে পারেনি। প্রথমার্ধে এমবাপ্পে বল পেয়েছে মোটে তিনবার। স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরুকে বাতাসে ভাসা বলে জিততে দেখিনি। বল তার কাছে যাওয়ার আগে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা ছোঁ মেরে নিয়ে নিয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, ৭০ মিনিট পর্যন্ত ফ্রান্সের মতো দল কেন বেহাল ছিল? আমি বলব, ফ্রান্সকে খেলতেই দেয়নি আর্জেন্টিনা। পুরো কৃতিত্ব আর্জেন্টিনার। এই আর্জেন্টিনা সত্যিই অন্য রকম ছিল।
মেসির মতো খেলোয়াড় নিজের পোস্টে এসে বল নিয়েছে। এতেই বোঝা যায়, ফাইনালে নীল-সাদা জার্সিধারীদের মানসিকতাই ছিল আলাদা। একটা খুনে মেজাজ দেখলাম। কোচ লিওনেল স্কালোনি পরিকল্পিতভাবেই শুরু থেকে ফ্রান্সকে চেপে ধরতে চেয়েছেন।
সেই পরিকল্পনা ম্যাচের অনেকটা সময় পর্যন্ত ভালোভাবেই বাস্তবায়ন করেছেন তাঁর খেলোয়াড়েরা। টাইব্রেকারে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার আগপর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। শেষে মেসির হাতেই বিশ্বকাপ!
Leave a Reply